বইটির প্রচ্ছদ কালো। দুই মলাটের মধ্যে ধরে রাখা গদ্যগুলোর আগাম পূর্বাভাষ দেয়। পুরুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক নির্ণয়ে অরণ্য বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছেন মানবসত্তার অন্ধকার দিকগুলির স্বরূপ উন্মোচন। লোভ, রিরংসা, যৌনতা, ক্ষুধা – যাবতীয় তামসিক উপাদানের মধ্যে গল্প গড়ে তোলার মধ্যেও আশ্চর্যজনকভাবে পাঠক থেকে যান আলোকবৃত্তে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘এখন আমি নিরাপদ’ সংকলনটির নামকরণ যথার্থ।
অরণ্যর গদ্যগুলির মূল শক্তি আবহ তৈরিতে। জাদুবাস্তবতার মোড়কে পরিবেশিত গদ্যগুলিতে সেটা একান্ত জরুরিও বটে। আর যেহেতু প্রতিটি গদ্য আকারে সংক্ষিপ্ত, তাই কাহিনি দ্রুত গড়ে তুলতে স্বভাবতই উঠে এসেছে সংকেতের ব্যবহার। প্রথম গল্প ‘আরশোলা’ এবং তারপর ‘কুকুর হইতে সাবধান’-এ সেই সংকেতের সফল ব্যবহার পাঠককে প্ররোচিত করে তোলে পরের গদ্যগুলো পড়ে ফেলতে।
আমার হত্যা করা প্রতিটি আরশোলার একটি করে নাম আমি দিতাম, আর তাদের হত্যার দিন, তারিখ, সময় সব লিখে রাখতাম। এভাবে ছয়শ’ একান্নটা নাম আমি লিখেছিলাম, যার প্রথমটি ছিল নিজের, দ্বিতীয়টি বাবার, এবং তৃতীয়টি মায়ের। (আরশোলা)
‘তিন বানর’ গল্পটি রূপকের ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে উঠেছে চরিত্রচিত্রণের একটি নিখুঁত আখ্যান। এমন গদ্য বারবার পড়ে ফেলা যায়। ‘বিকৃতির অন্তরালে’ এবং ‘শুক্রবার, আমি ও পোষা বেড়াল’ এমনই আরও দুটো গদ্য। একটা বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলে নিজের মতো করে পাঠককে পড়িয়ে নেওয়ার এমন সার্থক অনুশীলনের তারিফ করতেই হয়।
অনুশীলনের প্রসঙ্গেই মনে এল ‘এক-ই বাসের আমি বা আমরা’ গদ্যটির কথা। লেখক আত্মমগ্ন নিরীক্ষায় পাঠককে এনে ফেলেছেন তাঁর পরীক্ষাগারে। গদ্যের লিখন শৈলীর অন্যতম উপকরণ তার ভাষা। শব্দের যথাযথ ব্যবহারে অরণ্যের গদ্যগুলি মনোযোগী পাঠকের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে একটি উদ্ধৃতি ব্যবহারের লোভ সামলাতে পারলাম না।
ও যতক্ষণ ওভাবে কাঁদল আমি ওর বুকের ভেতরে মুখটা লুকিয়ে রেখে বুঝলাম, ওর ভাষা আছে, এবং সেটা অন্তত আমার ‘দুধ টেপা’ কিংবা ‘গাঢ় মারা’ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু সে তো আমাকে শেখায় না, বরং বার বার একা রেখে চলে যায়, যেখানে ওর মৃত স্বামীর দু’দুটো সন্তান আছে, আর আছে আমারই সমবয়সি দেবর, যে কিনা আমাকে নকল করে আর মনি বাচ্চা দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার গল্পের সিক ভাষাগুলোর মতো সব মেনে নেয়। (এক-ই বাসের আমি বা আমরা)
এ যেন লেখক নিজেই পাঠকের সঙ্গে তাঁর ভাষার মূল্যায়নে সামিল হয়েছেন। আর এখানেই কোথায় যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়াস দেখি এর পরের গদ্যটিতেও (গল্প লিখব না বলে)। এই পরীক্ষামূলক গদ্য বইটির প্রায় সব গল্পই উত্তমপুরুষে রচিত। লেখকের নিজের বিশ্লেষণ সরাসরি মিশে যায় ন্যারেশানে। বোধ হয় গদ্যের জন্যে সেগুলো একটি বাড়তি নির্ভরশীলতা জোগায়। কিন্তু সেখানেই প্রশ্ন ওঠে। পরীক্ষামূলক গদ্যে পাঠকের জন্যে আর একটু বাড়তি স্পেস রাখলে হত না? এই সংশয় মাথায় নিয়ে আবারও পাতা ওলটাই। আবার পড়তে শুরু করি ‘এখন আমি নিরাপদ’।